Tuesday, September 29, 2015

কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ

বাঙ্গালার তন্ত্রসাধনার ঐতিহ্য চলে আসছে বহুযুগ ধরে, সাংখ্যদর্শনের হাত ধরে বৌদ্ধধর্মের(বজ্রযান) মাধ্যমে বাঙ্গালীর তন্ত্রসাধনার উৎপত্তি। সেই তন্ত্রসাধনার ক্রিয়াকলাপ কিন্তু ছিল সকলের অগোচরে, কেবলমাত্র এর সাধকদের মধ্যেই এর নিয়মাবলী চর্চিত হতো। সেই তন্ত্রসাধনাকে প্রথম পুস্তক আকারে এমন বৃহৎপরিসরে প্রথম নিয়ে আসেন পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। তিনি এই রচনা করেছিলেন সংস্কৃতে, এবং মূলত তা নিয়মাবলী হিসাবেই রচিত তন্ত্রসাধনার অনুসারীদের জন্যই, কিন্তু সেই রচনার ঐতিহ্য এখনো প্রবাহমান। আমাদের বর্তমান কালীপূজার রূপ দান করেছিলেন পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ মহাশয়, দক্ষিণাকালিকার পূজাপদ্ধতির প্রবর্তন করে। সে সময় তার কাণ্ডকারখানাকে উপহাস করে আগমবাগীশী কাণ্ড বলা হতো, কিন্তু তাই হয়ে উঠেছে আমাদের পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

কৃষ্ণানন্দের জন্ম বারেন্দ্র শ্রেণীভুক্ত কাশ্যপ গোত্রীয় মণ্ডলজানীর মৈত্র বংশে। তাঁর লীলার সময় বেশিভাগ মানুষের মতে পঞ্চদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীতে। অনেকে অবশ্য তাঁকে সাধক রামপ্রসাদ সেনের গুরু হিসাবে বর্ণনা করেন, কিন্তু দুইজনের পূজাপদ্ধতির মধ্যে একটি সুস্পষ্ট তফাৎ ধরা পরে, যথা রামপ্রসাদ বাঙ্গালা ভাষায়, সকলের সামনে তাঁর ভক্তিকে প্রকট করেছেন কিন্তু উল্টোদিকে কৃষ্ণানন্দ ছিলেন তাঁর পূজার ব্যাপারে অত্যন্ত গোপনীয়তা মেনে চলার পক্ষে। একজন গুরু শিষ্যের মধ্যে সাধারণত এতোটা বৈপরীত্য প্রথম থেকেই বিরাজমান হয় না। তাই অধিকাংশ মানুষের মত অনুযায়ী তাঁকে আমরা শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক হিসাবেই দেখছি।

মহাপ্রভুর মত কৃষ্ণানন্দেরও বাস ছিল শ্রীধাম নবদ্বীপেই। সেইখানকার আগমেশ্বরী-তলা হল এই তন্ত্রশাস্ত্রে সুপণ্ডিতের লীলাক্ষেত্র। এই শক্তিসাধকের জন্ম কিন্তু এক বৈষ্ণব পরিবারেই, তাঁদের পারিবারিক দেবতা রাধাবল্লভ প্রায় ৮০০ বৎসরের পুরনো। শোনা যায় শ্রীচৈতন্য, রঘুনাথ শিরোমণি এবং কৃষ্ণানন্দ এক গুরুর কাছে অধ্যয়ন করতেন, কিন্তু পরবর্তীতে কৃষ্ণের ভজনা থেকে শ্রীচৈতন্যকে বিরত থাকতে অনুরোধ জানানোর পর কৃষ্ণানন্দের সাথে শ্রীচৈতন্যের মনোমালিন্য হয়, এবং দুইজনের পথ পৃথক হয়। কৃষ্ণানন্দ শক্তিসাধনায় সিদ্ধিলাভ করে কালিকামূর্তির রূপ প্রদান করেন, ইতিপূর্বে কালীপূজা হতো ঘটে।

কৃষ্ণানন্দের ভাই সহস্রাক্ষ(মতান্তরে মাধবাচার্য্য) ছিলেন বৈষ্ণব, এবং সেই নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে ছিল বিরোধ। একবার তাঁদের গৃহে এক কাঁদি মর্তমান কলা হওয়ার পর দুই ভাই মনে মনে ঠিক করেছিলেন তাঁদের স্বীয় ইষ্টদেবতাকে সেই ফল ভোগ হিসাবে দেবেন। ফল পাকার সময় কৃষ্ণানন্দ উপস্থিত না থাকার কারণে তাঁর ভাই সেই ফল নিয়ে তাঁর ঠাকুরঘরে রেখে আসেন পরেরদিন ভোগের জন্য। কৃষ্ণানন্দ ফিরে এসে সে কথা জানার পর সেই ঠাকুরঘরে যান সবার অগোচরে কলা নিয়ে আসতে। সেই সময় তিনি দেখেন মা নিজে হাতে গোপালকে সেই ভোগ খাইয়ে দিচ্ছেন। সেই সময় থেকে দুই ভাইয়ের মধ্যে তাঁদের স্বীয় মত অনুযায়ী পূজা অর্চনার কারণে ঘটিত বিবাদভঞ্জন হয়। এটি একটি সুপ্রচলিত গল্প, কিন্তু এর মাধ্যমে শাক্ত এবং বৈষ্ণব মতের মধ্যে যে মেলবন্ধন, যা আমরা পরিবর্তীকালেও এই বাঙ্গালার বুকে শাক্তসাধনার অঙ্গ হিসাবে পাই তা আবার প্রতিফলিত হয়।

তাঁর 'তন্ত্রসার' গ্রন্থ যা তাঁকে সর্বাধিক পরিচিতি প্রদান করেছে তা তন্ত্রশাস্ত্রের সকল ক্রিয়াকে একত্রে সংকলিত করেছে। এর পূর্বে এমন স্বয়ং সর্বস্ব কোন গ্রন্থ ছিল না। এই প্রসঙ্গে আর একটি কিংবদন্তীর কথা উল্লেখযোগ্য যা হল আদ্যাশক্তির রূপ সম্পর্কিত। সেই সময়ে আদ্যাশক্তির কোন মূর্তি ছিল না, তিনি স্বপ্নে কৃষ্ণানন্দকে দেখা দিয়ে বলেন তাঁর মূর্তি প্রকাশ করতে সকালে উঠে প্রথম দেখা মূর্তি অনুসারে। সকালে উঠে কৃষ্ণানন্দ প্রথম দেখলেন এক গোপরমণীকে যিনি লজ্জায় জিভ বের করে ফেলেন। সেই অনুসারেই আদ্যাশক্তির মূর্তি সৃষ্টি করেন কৃষ্ণানন্দ। প্রতিদিন দক্ষিণাকালীর মূর্তি নিজের হাতে গড়ে পূজা করতেন কৃষ্ণানন্দ। একদিন সকালে তাঁকে বিসর্জন দিতে যাওয়ার সময় তা দেখেন একজন কাজী এবং নিকটস্থ ভূস্বামীকে সে কথা জানান। এরপরে সেই ভূস্বামী এসে কৃষ্ণানন্দের কাছ থেকে আশীর্বাদ চান দুই হাতে, এবং সেই আশীর্বাদ করার সময় উনি সেই মূর্তি দেখেন এবং এই বিষয়ে জানতে চান। তখন কৃষ্ণানন্দ তাঁর স্বপ্নবিবরণ এবং তন্ত্রসার গ্রন্থের কথা প্রকাশ করেন। তখন রাজা সেই পূজাকে বৃহদাকারে সম্পন্ন করেন এবং কৃষ্ণানন্দকে আগমবাগীশ উপাধি প্রদান করেন। সেই থেকে কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে অদ্যাবধি শ্যামাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
কৃষ্ণানন্দের পুত্রের সাথে বিবাহ হয় সাধক জটীয়া যাদুর কন্যার। তাঁর উত্তরপুরুষের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কৃষ্ণমঙ্গল বিদ্যাবাগীশ, রামতোষণ বিদ্যালঙ্কার, রামলোভন বিদ্যাভূষণ ইত্যাদি। রামতোষণ হাতিবাগানের চতুষ্পাঠী স্থাপন করেন, এবং খড়দহের বিশ্বাস বংশের প্রাণকৃষ্ণ বিশ্বাসের অর্থানুকূল্যে তন্ত্রের আর এক বিখ্যাত গ্রন্থ 'প্রাণতোষিণী মহাতন্ত্র' প্রকাশ করেন। 

Wednesday, September 16, 2015

অপ্রাপ্তির হিসেবনিকেশ

তখন আমি অনেক কম বয়সী
তখন সাধ জেগেছিল চুম্বনের
সমস্ত ভূমণ্ডল, পৃথিবী সব কিছু অগ্রাহ্য করে
শুধু চুম্বন চলতে থাকবে, ওষ্ঠ থেকে ওষ্ঠের মধ্যেই সঙ্কুচিত হবে সর্বস্ব
কিন্তু পাইনি
চেষ্টাও যে করেছি এমন নয়
হয়তো প্রথম যৌনতার হাতেখড়ি
ঔচিত্য যে যুদ্ধে সহজ জয় ছিনিয়ে নেয়
কোন দুষ্ট সরস্বতীর কাছে সুবিচার চাই
সে শিক্ষার অপূর্ণতা, দোষ যে আমারই তাই প্রতিকার সেও তো আমার
তাই এই ফলশ্রুতি
তাই বুঝি এই অবক্ষয়
উচিৎ অনুচিতের বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে গেছি
চুম্বন রয়ে গেছে অন্ধকূপে
ওষ্ঠাধার রয়ে গেছে অসিক্ত
আমার নিজের ইচ্ছায় সে শুষ্কতাকে বরণ করেছি সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে
নিজস্ব সিদ্ধান্ত
তবু আজ বড় অনুশোচনা হয়

Sunday, September 6, 2015

স্বপ্ন ফেরীর দেশে

আলস্যে আজ দিচ্ছি পারি ঘুমের ঘোরে
ভাসছি বিনা ক্লান্তিতে নীল মেঘের উপর
বেড-টি তো সে জুড়িয়ে গেল সাতসকালে
ফিরছি যখন নাম না জানা অচিনপুরে ।
কয়েক যোজন সেই খেয়ালী রাস্তা ধরে
ধুলোর মাঝে ফটফটিয়ে ফেলছি চটি
বৃষ্টি বেবাক করুণ সূরে বলছে বুঝি
ধুলোই নাহয় আজকে দেদার উড়ুক ওরে।
প্রাত্যহিকী পারির শেষে অন্ত্যমিলে
ভাঙবে আবার স্তব্ধতা সেই উগ্র ডাকে
সাবধানী ঢিল সেই তো আবার পড়বে এসে
করবে আবার দোদুল্যমান ঘুমের ঝিলে।
যদিও সে রোজ এমনি ডাকে কাজের দিনে
আজকে নাহয় জিতুক কিছু অন্য ভাবেই,
গড়ুক কিছু নতুন স্মৃতি, দেওয়াল ভেঙ্গে,
ব্যস্ততাহীন ঘুমের সে দেশ প্রদক্ষিণে ।