Friday, March 13, 2015

পানীয়ঃ প্রয়োজনীয়তা বনাম বিলাসিতা

বাঙালী আঁতেল-মাত্র যে পানীয়ের সাথে নিজেকে একাত্ম করতে ভালবাসে, বা বলা যায় যার দরুন তার আঁতলামির সূচক লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায় তা হল চা । সেই ভেলায় আমিও যে কখনো গা ভাসাইনি এমনও নয়, চিরাচরিত বাঙালী মানসিকতা অনুযায়ী আঁতেল হওয়ার শখ কার না জন্মায় । গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসেছিলাম আমিও কয়দিনের জন্য, কয়দিন বললে ভুল হবে, রীতিমত অনেকদিন, অন্তত মানবজীবনের স্থিতিকালের কথা বিচার করলে তাকে কোনরূপেই নগণ্য বলা চলে না । স্কুল জীবনে চা খেতাম না একদমই অবশ্য, এখনো তেমন খাই না । মাঝখানে কেবল পাঁচ বছর খেয়েছিলাম কলেজে পড়ার সময়, অনেকটা দাম্পত্যের মধ্যভাগে অন্য জিভেগজার মতই বলা চলে । যৌবনযাপনের স্রোতে ভেসে এরকম অল্প কিছু ভুলচুক করেনি এমন বাঙালী মেলা ভার, তবে তুল্যমূল্যের বিচারে আমি ক্ষুদ্র পাপী হিসেবেই পরিগনিত হব বলে বোধ হয় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের চোখে । এই আধুনিক যুগের সান্ধ্যবাসর উনি চর্মচক্ষে প্রত্যক্ষ করলে পরিস্থিতি কি হত সে কথা মানসচক্ষে দেখতে পাওয়া খুব একটা দুষ্কর নয় । 

বনহুগলী চত্বরের প্রায় সমস্ত চায়ের দোকানেই খেয়েছি, বেশিভাগ পরস্মৈপদী । অভিষেক বলে একজন বন্ধু ছিল, তার মাঝে মাঝে চায়ের তেষ্টা পেত । আমি ছিলাম তার চায়ের গেলাসের ইয়ার । সেই সুযোগে বিনামূল্যে চা খেয়ে আসতাম । খুব একটা ভাল লাগতো যে এমন নয়, তাও খেতাম । যেটা তৃপ্তি করে খেতাম সেটা হল তাপসদার দোকানের স্পেশাল চা, সঙ্গে গজা । ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছি তাপসদার দোকানের বেঞ্চিতে । চা নিয়ে বা না নিয়ে, তাপসদা এসে পাখা বন্ধ করে দিয়েছে, আবার হয়তো কোন মহানুভব এসে উপস্থিত হয়েছে হস্টেল থেকে, এক কাপ চা নিয়েছে, এবং আমরা আবার খানিকক্ষণ মলয়বাতাসে ভেসে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। 

চিরায়ত বাঙালী সমাজব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত এই পানীয়ের মূল্যায়ন করার মত ক্ষমতা আমি রাখিনা, নিজেকে তার যোগ্য বলে মনেও করিনা । নব্য সংস্কৃতিতে বিকশিত হওয়া বিশ্বমানবের কাছে হয়তো এই অনুরাগ স্বাভাবিক বলে নাও হতে পারে, কিন্তু দ্বিপ্রহরে স্টারবাক্সের কফির স্রোতের সাথে তুফানতোলা সেই সব যুক্তি অনুধাবন করার মত ক্ষমতা এখনো আমি অর্জন করতে পারিনি বলেই মূল্যায়ন হতে আমি শতহস্ত দূরে, সন্ধ্যাবসরের পানীয় সমভিব্যহারে পরিবেশিত বক্তব্যের কথা তো বাদই দিলাম । নিজের এই অক্ষমতা আমি নতমস্তকে স্বীকার করছি ।  

যুগোপযোগী রসাস্বাদন ব্যতীত বুদ্ধিজীবী পরিমণ্ডলে সুনাম অর্জন করার পথ খুব একটা সুগম নয়, পদে পদে তা বিলক্ষণ টের পেয়ে থাকি, কিন্তু ব্যঘ্রচর্মে আচ্ছাদিত শৃগাল হয়ে যে বেশীদিন সে মহলে টিকতে পারব সে আশা দেখিনা । এবং শ্রীনাথ বহুরূপীর মত লেজ কেটে বিদায় নিতেও মন চায়না । তাই মধ্যপন্থা অবলম্বন করাই শ্রেয় বলে মনে করে থাকলেও, রণে ভঙ্গ দিলাম, হয়তো যথেষ্ট সংগ্রামী ইতিহাসের শক্তি নেই সাথে বলে । 

সাহচর্য দীর্ঘস্থায়ী না হলেও উপাদেয় ছিল নিঃসন্দেহে, তবে আধুনিক কাফের স্বাচ্ছন্দ্য সেই ভাঙ্গাচোরা কাঠের বেঞ্চিতে খুঁজলে যে তৃপ্তি মিলবে এমন কথা বলতে পারিনা । সত্যি তো, সারা দিনরাত আমাদের মাথার ঘাম পায়ে ঝড়িয়ে ভাবনা চিন্তার মাধ্যমে দেশোদ্ধারের পর তো এই দেহের প্রয়োজন কিছু নরম গালিচার । এই সরল সত্যটুকু যদি অনুধাবন না করে উঠতে পারেন পাড়ার বিশুদা, তবে কেমন করে তিনি পাল্লা দেবেন স্টারবাক্সের সাথে? সংগ্রামী শ্রেণীর সম্বন্ধে এটুকু সচেতনতা না হলে আর কিসের সে প্রলেতারিয়ত ।  


আমি সামান্য মানুষ, খুব বেশি হলে একটা এলাচ, দু ফোঁটা আদার রস, বিলাসিতা সামান্যই । এই হল মধ্যপন্থা, যদিও তাও সইল না কপালে বেশীদিন । ধরি মাছ না ছুঁই পানি কি আর বেশীদিন চলে, সেই প্রিয়তম মৎস্যের সাথে বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো, অবগাহনভীতি থেকে । হারিয়ে যাব জানি, যেমন গিয়েছে যুগ যুগ ধরে মানুষ, সময়ের সাথে সাথে আত্মপরিচয়কে যথেষ্ট পরিমানে পরিবর্তিত করতে পারেনা বলে বিবর্তনপ্রক্রিয়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখে । বিলাসিতাই তো ক্রমে একদিন প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে, সেই সহজ সত্য যুগ যুগ ধরে অসংখ্য উদাহরণ দেখেও অনুধাবন না করতে পারার যা অক্ষমতা তো কিছু কম অপরাধ নয় । 

No comments:

Post a Comment