Friday, May 8, 2015

নাট্যচর্চা

জীবনের রঙ্গমঞ্চে অনেকদিনের অভিনয়ের অভ্যাস, সেই অভিনয় করায় যে স্বতস্ফুর্ততা দেখিয়ে আসি এতদিনের অভ্যাসের পর তা কখনো মেকি রঙ্গমঞ্চে দেখাতে পারব বলে মনে হয়না, তবে অনেকে পারেন। মঞ্চস্থ নাটক দেখবার উদ্দেশ্য অবশ্য এমনটা এ কথা আমি দাবী করছি না।  বস্তুত সবকিছুই যে কোন একরকমের মঞ্চ সে কথা আদৌ মনে থাকে বা আর কতক্ষণ। আমরা তো সেই পাইকারী হারে আপেক্ষিকতাকেই বেশি মূল্য দিয়ে এসেছি বংশগত বা সমাজগত ভাবে। আর তাই মাঝে মাঝে বুঝি সেই সংস্কৃতির চরকায় তেল দিতেই ঘুরে আসি এদিক সেদিক, রুচিকে আর একটু পরিশুদ্ধ করতে।
কাল গেলাম অপেরা শুনতে। হঠাৎ চলে গেলাম, যাব যাব করে যাওয়া হয় না, শেষ অঙ্কে কষ্টে ল্যাদ কাটিয়ে এতদিনে গেছি, এই ধরণের কোন ব্যাপারই না। খুব তীব্র ইচ্ছা জেগে উঠেছিল মনের মধ্যে, এরকম কথাও বলতে পারি না। তবু চলে গেলাম, ঠিক যেমন করে দেখতে গিয়েছিলাম কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রের 'মেয়েটি', তা প্রায় বছর পাঁচেক আগে । নাটক তার আগেও দেখেছি, কিন্তু সেই নাটকটা যেন নতুন করে নাটকের সাথে আমার সম্পর্কের সূচনা ঘটায়। তেমন অবশ্য ঘটালো না 'দ্য বুক অফ মরমন', তবু একটা ঘটনা।
সুসজ্জিত মঞ্চ, ব্রডওয়ে থিয়েটার, দারুন আলোকসজ্জা, এদেশে নাট্যচর্চার রূপ নিঃসন্দেহে বেশ উন্নত। মাঁচা বেঁধে দিন আনি দিন খাই অবস্থার সাথে তার তুলনা চলে না। সেই মোহন রূপে কে রয় ভুলে। পানীয়ের সুব্যবস্থা, আরামদায়ক আরামকেদারা, অজস্র গ্যালারী, ড্রেস সার্কেল, এবং নিশ্চিতভাবে সেসবের জন্য যথেষ্ট পরিমান পকেট হালকা করতে হবে। আমি অবশ্য যেটুকু না দিলেই নয় তার বাইরে হাঁটবার তেমন সাহস দেখাতে পারিনি, রক্তের গুণ যাবে কোথায়।
নাটক বা গীতিনাট্য যাই বলি, তাদের পেশাদারিত্ব অবশ্যই সন্দেহাতীত, দক্ষ অভিনেতা সে নিয়েও সন্দেহ নেই। সেই গুণাবলীর কারণেই হলিউডের দৌরাত্ম্যের মধ্যেও নিজেদের স্থান ধরে রাখতে সক্ষম এদেশের মঞ্চ। এছাড়া অবশ্যই সংলাপ, সঙ্গীত ইত্যাদি ক্ষেত্রেও তাদের প্রতিভা অতুলনীয়। দর্শক আসন মূলত মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত দর্শকে পরিপূর্ণ। তাদের মনোরঞ্জন করার ক্ষেত্র খুব সুন্দর ভাবে প্রস্তুত ছিল সমগ্র নাটিকা জুড়ে। কিন্তু এতো কিছু সত্ত্বেও একটা ব্যাপার যেন আমাকে আমার মাথায় ঘুরপাক খেতেই থাকল, তা হল সাহসিকতা।
আমি এদেশে রয়েছি কেবল এক নিঃসঙ্গ দ্বীপ হিসাবে, তাই মতামত ব্যক্ত করাও হয়তো নির্বুদ্ধিতা, কোন সমালোচনা হয়তো হঠকারী সিদ্ধান্ত, বিশেষ করে যে বর্তমান সময়ের মধ্যে আমি বিচরণ করছি এবং তারা বিচরণ করছে সেই পরিপ্রেক্ষিতে। ধ্বংসাত্মক মনোবৃত্তি নির্মোহ চিন্তা থেকে উদ্ভূত এমন দাবীও আমি রাখছি না, এবং আপোষহীন অবস্থান হয়তো কেবল রোমান্টিকতাই, তাতে কোন উন্নতিসাধনের লেশমাত্র স্ফুলিঙ্গ লুকায়িত নেই, এই জাতীয় দাবীর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত নাহলে তার যৌক্তিকতা উপেক্ষা করতে পারি না । তবু হয়তো, কিছুটা 'অবাঞ্ছিত' জাতীয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গির 'কুফল' স্বরূপ, এই প্রচেষ্টার মধ্যেও শোধনবাদিতার চিহ্নই বেশী দৃশ্যমান হয় তার কাছে, ভারতের সমতুল্য প্রচেষ্টাগুলোর চেয়ে অনেকাংশে বেশী। নিঃসন্দেহে ধর্মীয় অনুভূতি অনেক সহজে আহত হয় আমাদের দেশে, এই জাতীয় অতিসাধারণিকৃত বক্তব্যের জোয়ারে ভেসে যেতে আমি আমি অরাজি। যীশু এবং তার আদর্শে অনুপ্রাণিত নতুন যুগের সন্ন্যাসীদের সম্বন্ধে আমি নিতান্ত অজ্ঞ, কিন্তু তাদের বক্তব্যের অযৌক্তিকতার কথা তুলে ধরা হয়েছিল সুচারু ভাবে। সেই উপস্থাপনা ছিল নান্দনিক, এবং হাস্যরসে পরিপূর্ণ। কিছু ভণ্ড ইমারৎ খসে পড়ার দৃশ্যাবলী প্রত্যক্ষ করতে করতে উৎফুল্ল হয়ে উঠছিলাম আনন্দে, কিন্তু সেই চিরাচরিত মীমাংসাসূত্র।
ভাবছিলাম আমাদের দেশের কথা, সেখানে ধর্মানুভূতি আহত হয়ে থাকে মাঝে মাঝেই, কিন্তু ব্যাঙ্গাত্মক নির্দেশনার ক্ষেত্রে কি আমরা অনেক বেশী সহনশীল নই? কিন্তু শেষ মুহূর্তে কোন আপোষে আসার কি কোন প্রয়োজন থাকে? বিভিন্ন প্রদর্শনীর বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ বিক্ষোভ হয় না এমন নয়, কিন্তু নিছক হাস্যরস পরিবেশনার ক্ষেত্রে কি সত্যি কোন প্রয়োজন থাকে শেষ মুহূর্তে ধর্মীয় গ্রন্থকে কেবল রূপক হিসাবে দেখানোর? এক অর্থে হাস্যরসের ভিত্তি কি তাতে আহত হয়না খানিকটা? জানি না, জানার অনেক কিছু আছে, সংস্কৃতিকে চেনার আছে, মানুষের মনস্তত্ত্ব, তার অস্তিত্বসঙ্কট, তার অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা, এবং সেই থেকে উদ্ভূত রফাসূত্রের খোঁজ। সত্যি আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না।





No comments:

Post a Comment