Monday, August 3, 2015

ইয়াকুব

ইয়াকুব মালিক-- হয়তো বা কিছু মানুষের কাছে ছিল স্মৃতির গভীরে, কিছু মানুষের কাছে সততই মগজের ক্যানভাসে ভেসে ওঠা একটা নাম। এই দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ কিন্তু আদপে একে অপরের থেকে অনেকটাই আলাদা হতে পারে, কেউ হয়তো তার আপনজন, কেউ তার আপনজনের হত্যাকারী হিসাবে মনে রাখে ইয়াকুবকে। এদের ছেড়ে দিলেও ভারতের অসংখ্য জনসাধারণের চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছিল ইয়াকুব ভারতের ইতিহাসে এক ভয়াবহ ঘটনার আইনি পরিণতির রূপ হিসাবে।
ফাঁসির আদেশ তাকে নিম্ন আদালত থেকে সর্বোচ্চ আদালত সবাই শুনিয়েছে বেশ কিছুদিন যাবৎ, এমন কি রাষ্ট্রপতি ক্ষমাভিক্ষার অর্র্জি ফিরিয়েছেন তাও কিছুদিন হল।  অবশেষে সেই শেষ সময় কাছাকাছি আসার সাথে সাথে আবার বেশ কিছু চর্চা শুরু হল, যা হয়তো আগেও হয়েছে কিছু কম মাত্রায়। এমনিতে ভারতে ইদানিংকালে মৃত্যদন্ড খুব বেশি কার্যকর হয়নি, যাও বা হয়েছে তাও খুব চুপচাপ অনেকের অজ্ঞাতসারে। কিন্তু এই ঘটনাটি হয়ে উঠল বহুলচর্চিত একটি বিষয়।
মৃত্যুদন্ডের উপযোগিতা নিয়ে অনেকদিন যাবৎ আলাপ আলোচনা চলছেই, প্রায় প্রতিটি মৃত্যুদন্ডের সময় আবার তা মাথাচাড়া দেয়।  স্বাভাবিকভাবে উঠে আসে বিভিন্ন দেশের কথা যারা এই প্রথা বর্জন করেছে। কিন্তু সেই অর্থে এই বিষয়ে তেমন অগ্রগতি হয়না, বা হলেও তা থেকে যায় সাধারণ নাগরিকের কাছে অজানা। ভারতের ক্ষেত্র আলাদা করে পর্যালোচনা করে, বিশেষ করে সীমান্তপারের সম্পর্ক, এবং জঙ্গি হামলার ইতিহাস পর্যালোচনা করে, বা ভারতের ভূমন্ডলে এই শাস্তির মনস্তাত্ত্বিক ফল অপরাধপ্রবণতার উপর কেমন প্রভাব ফেলে সে বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনার এখনো অভাব রয়ে গেছে।
অবশ্য অনেকে আছেন যারা এই মৃত্যুদন্ডের বিরোধিতা না করেও ইয়াকুবের প্রাণভিক্ষার পক্ষে। তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি হল ইয়াকুবের আত্মসমর্পণ। তার সপক্ষে তারা ভারতের প্রাক্তন গোয়েন্দা বি রমনের ২০০৭ সালে রচিত একটি প্রবন্ধ উল্লেখ করছেন। সমস্যা হল তিনিও দাবি করেছেন যে ইয়াকুব একদা আত্মসমর্পণ করার বাসনা নিয়ে নেপাল এলেও আইনজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী সে বাসনা ত্যাগ করে ফের পারি দিচ্ছিলেন করাচীতে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে তার এবং তার পরিবারের ভারতীয় পাসপোর্টের কারণে তিনি ধরা পরে যান। তিনি অবশ্য অনেক প্রামান্য নথী নিয়ে রেখেছিলেন নিজের কাছে, যা পরে তদন্তে সাহায্য করে।  কিন্তু যেহেতু তিনি আত্মসমর্পণের বাসনা ত্যাগ করেই ফেলেছিলেন তখন কাজেই সেই যুক্তিতে ফাঁসির বিরোধিতা টেকে না।
দ্বিতীয় বক্তব্য হল তদন্তে সাহায্যের। এ কথা অনস্বীকার্য যে ইয়াকুব তদন্তকারীদের অনেক সাহায্য করেছিলেন গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই। কিন্তু যেমন একজন ডুবন্ত মানুষ শেষ কাঠের টুকরো আঁকড়ে বাঁচার চেষ্টা করে তেমনই ছিল হয়তো ইয়াকুবের এই চেষ্টা। নিজের শাস্তি কমানোর জন্য এই পন্থা অবলম্বন করা ছাড়া আর কোন উপায়ান্তর তার ছিল কিনা সেটাও ভেবে দেখার মতো ব্যাপার।
এছাড়া অনেকে এই যুক্তি উপস্থাপন করছেন যে তার সহযোগী অনেকে এই মামলায় যাবজ্জীবন বা তার থেকেও কম শাস্তি পেয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন, যাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো নিজে হাতে এই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। কিন্তু ভারতের আদালত চিরকাল মূল চক্রান্তকারীদের সাজার ব্যাপারে বেশি কঠোর থেকেছে সৈনিকদের থেকে। এ ক্ষেত্রে প্রমান যে কথা বলছে তা হল এই সমস্ত কিছুর পিছনে অর্থনৈতিক সাহায্য থেকে অস্ত্রের যোগান, সব হয়েছে ইয়াকুবের হাত ধরে, যে অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে ইয়াকুব।
ইয়াকুব শেষ পর্যন্ত বলে এসেছে সে নির্দোষ, কিন্তু আদালত কাজ করে প্রমানের উপর ভিত্তি করে। ইয়াকুবের তার ভাইয়ের ব্যবসায় সাহায্য থেকে শুরু করে নিজের গাড়ি তাদের ব্যবহারের জন্য দিয়েছে কোন ইতস্ততা ছাড়াই। যদি ধরেও নেওয়া যায় যে সে আসল ঘটনা সম্পর্কে ছিল সম্পুর্ন অজ্ঞ, এবং তার অজান্তেই সমস্ত কিছু ঘটে গেছে তার মাধ্যমে তাহলেও কিন্তু এর জন্য দোষ দেওয়া চলে না ভারতের আদালতকে, বরং দোষ বর্তায় তার নিজের ভাই টাইগার মেমনের উপরেই, এবং কিছু অংশে ইয়াকুবের নিজের উপরেও।  এবং সে কথা সে বুঝতে পেরেছিল বলেই হয়তো সে আত্মসমর্পণের সংকল্প ত্যাগ করেছিল। 

No comments:

Post a Comment