Thursday, January 28, 2016

অজানা কিছু দিনের কথা

আমাদের জীবনে অনেক মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকে, তার মধ্যে হাতে গোনা কিছু মানুষ প্রভাব বিস্তার করে আপাতভাবে আমাদের উপর। এছাড়াও কিন্তু প্রতিনিয়তই অজস্র মানুষের সাহচর্য পাই যা আমাদের অন্তরে রয়ে যায় নগণ্য ভূমিকার অধিকারী হিসাবে। এর মধ্যে থাকে হয়তো আমাদের নিকটাত্মীয় অনেক মানুষ, যারা চাইলেও আমাদের পরমাত্মীয় হয়ে উঠতে পারেননি কিছুটা আমাদেরই গাফিলতিতে। কিছু তাদের প্রভাব আমরা আমাদের জীবনে যতই অস্বীকার করতে যাই, হাসেন অন্তর্যামী। কিছু প্রভাব সুস্পষ্ট, কারণ তাতে মিশে আছে বলপ্রয়োগ, কিছু প্রভাব সূক্ষ্ম, কিন্তু তা অযত্নশীল এবং তাই আমাদের উপেক্ষার পাত্র হয়েই রয়ে যায় চিরদিন, যদিও আমাদের মননে তারই সংখ্যাধিক্য। তেমনই কিছু মানুষের গল্প মাঝেমাঝে আমাদের চোখের সামনে আচম্বিতেই ঝলক লাগিয়ে আমাদের অবাক করে দেয়, যদিও আপাতদৃষ্টিতে তা তেমন কিছু আশ্চর্যজনক নয়। হয়তো সেই কারণেই বিস্মিত হই এতো বেশী।

অনুভূতি, জীবনদর্শন, ইতিহাস, সব অস্তাচলে নিমগ্ন হয়ে যায় প্রতিনিয়ত, আমাদের চোখের সামনেই অথচ অগোচরে। বিবিধের মাঝে মহানের খোঁজ করা ছেড়ে এসেছি কতকাল পূর্বেই। অথচ এই সামান্য কিছু অসামান্য কাহিনী আমাদের বলে দেয় কত ভালোবাসার, কত সাম্যের কথা, কত পূর্ণতার কথা। অতীতের এই উপাখ্যান কে অস্বীকার করে নেয়, তার প্রতি কিছু সহানুভূতি নিয়ে যদি আমরা একটু পথচলার চেষ্টা করতাম, তাহলে হয়তো জীবনের অনেক দুঃসহ গাঁথার সমাধান অনেক সহজেই প্রাপ্ত হতাম।

তেমনই গল্পের রসদ পাই আমাদের ঠাকুমা দিদিমাদের থেকে, যাদের দেখে আসছি ছোট থেকেই এবং দূরে ঠেলে আসছি সময়ের সাথে সাথে আরও দূর্বার গতিতে। তেমনই এক ঠাকুমার কথা বলার জন্য এত ভণিতা, যিনি জন্মেছিলেন এক রাজপরিবারে। অস্থির সময়, ধর্মের রাজনীতি তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল তার ধনসম্পদের সাথে সাথে তার পরিচয়টাও, তার শৈশব কৈশোর সবকিছুই চিহ্নিত হয়েছে অলীক কুনাট্য হিসাবে, এমনকি তার কাছের মানুষের থেকেও। একা হয়ে গিয়েছেন ক্রমশ নিজের দুনিয়ায়, তবু সযত্নে লালন করেছেন সেই স্মৃতিকেই। দুঃস্বপ্নের যন্ত্রণা বলে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়তো সহজ কাজ, অন্তত সময়ের স্রোতে ভেসে চলার জন্য তাই আমাদের বর্তমান রীতি, তবু বিশ্বাসের উপর ভর করে বেঁচে চলার প্রত্যয় সার্বজনীন না হলেও সম্পূর্ণ অবলুপ্ত নয়।

রাজপরিবার সম্পর্কে আধুনিককালে অনেকের মনেই একটি সন্দেহ এবং ঘৃণার ভাব প্রকট হয়, ঐশ্বর্যের সাথে সাথে এই বাস্তবের সাথেও তাদের হয়তো বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছে। অত্যাচারী যে তারা একেবারেই নন এমন দাবী করাও হয়তো চলে না, অথবা অর্থের অপচয় যে তারা করেননি এমনও হলফ করে বলা চলে না। তবু নিজেদের মত করে উন্নয়নের চেষ্টাও যে তারা করেননি এমনও নয়। হাতিশালে হাতি ঘোড়াশালে ঘোড়ার সাথে সাথে শিক্ষাঙ্গনের উন্নতির প্রতিও তারা কিঞ্চিৎ মনোযোগ অবশ্যই দিয়েছেন, এমন সেখানে রাজপরিবারের সন্তানদের পাশাপাশি প্রজাদের বঞ্চিত করে রাখার প্রচেষ্টা বিদ্যমান ছিল না। আর দশটা সাধারণ বাঙ্গালী পরিবারের তুলনায় জীবনধারণে বাত্যয় ছিল না, হাসিকান্না ভালোবাসা রাজকীয়তার সাথে লোপ পায় এমন ধারণা আমরা যদি করে থাকি তাহলে তা বাস্তবের সাথে তেমন সাযুজ্য রাখে না। নারী হিসাবে প্রাচুর্যের মধ্যেও অবশ্য অপ্রাপ্তির অন্ত নেই সেই যুগের সাথে তাল মিলিয়েই, খাওয়া দাওয়া শিক্ষা ইত্যাদির ক্ষেত্রে, আবার সেই সাথে খুনসুটির গল্পও। তবে বুর্জোয়াদের আয়েশি গল্পের সাথে তা মেলে না, বরং  স্বয়ংসম্পূর্ণতার ধারণা এমন সুস্পষ্ট করে কম মানুষের মধ্যেই দেখেছি, পারিবারিক নানা অশান্তির কারণেও যা ত্যাগ করেননি তিনি আদর্শ হিসাবে। বর্তমানের কাঁচ চোখ থেমে নামিয়ে ফেললে যেন চলে আসে আশ্চর্যজনকভাবে অনেক বেশী স্বচ্ছতা। 'দূর'দৃষ্টিসম্পন্ন যে আমরা এখনো হয়ে উঠিনি এতোটুকু তা আবার অনুভব করতে হয়, সে যতই তা নিয়ে গর্ববোধ করি না কেন। বর্তমানে কেবল অতীতকে অযৌক্তিক ঘৃণা করাই নয়, বরং  তার থেকেও বেশী আমরা নিজেরাই পিছিয়ে গিয়েছি অনেক দিক থেকে সেই অতীতের চেয়েও। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের এই হালের শাইন করার বিষয়ে খেদোক্তি দেখে যতই আমরা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করি না কেন, তার প্রতি মুখ ফিরিয়ে থাকা বোধকরি সম্ভব নয়। 

No comments:

Post a Comment