Sunday, February 22, 2015

বিমানযাত্রার রোমাঞ্চ

বিমানযাত্রা, তার মধ্যে আবার রোমাঞ্চ- প্রথমেই যেন অলীক কুনাট্য ! আধুনিক যুগে যখন বিমানযাত্রা মানুষের কাছে জলভাত, তখন তার মধ্যে রোমাঞ্চ খুঁজে পাওয়ার মধ্যে হয়তো অনেকেই আশ্চর্য হবেন । আমি নিজের জীবনে বিমানে চড়েছি খুব কম, তবে এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার পূর্বে আমি কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি এরকম পরিস্থিতির কথা । হয়তো চিন্তামণির মত চিন্তা করার ক্ষমতা ছিল না, কিন্তু বাস্তব সেসব অভাবকে ঘুচিয়ে একদিনে অভিজ্ঞতার  ঘড়া অনেকখানি পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো সেই এক বিমানযাত্রার মাধ্যমেই । শিকাগোতে আসা থেকে বছরে দুই একবার ভাসতে হয় উড়োজাহাজে, তবে সেই সুবাদে নিজেকে বিমানযাত্রার বিশেষজ্ঞ বলে আমি দাবী করি না । হয়তো এমন অভিজ্ঞতা অনেকের রোজনামচার মধ্যে থাকে, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব এবং অকল্পনীয়- তাই আকস্মিক এবং আকর্ষক ।

কলকাতা ছাড়া আমার কাছে কোনদিনই খুব সুখকর নয়, এবারো ছিল না, জানুয়ারির ৫ তারিখ । প্রথম শুরুটা অবশ্য মন্দ হল না, যাত্রা কিছুক্ষণের জন্য বিলম্বিত হয়ে যাওয়ার কারণে । আসলে যতটুকু পারা যায়, কাছে থাকা কলকাতার । কিন্তু সব কিছুর শেষ আছে, অথবা হয়ত শেষ নেই -শুধু নতুন করে পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ।  সেই নতুন করে পেতেই অল্প কদিনের বিচ্ছেদ।  সেসব চিন্তা করতে করতেই দাঁড়ালাম চেক-ইন'এর সারিতে।  অতীতের হিসেব অনুযায়ী  এগুলো ছিল মিনিট কয়েকের অপেক্ষামাত্র, কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেখি সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়, আর আমি থেকে যাই সেই একই স্থানে।  প্রথমে ভেবেছিলাম যে বাংলা হয়তো এখন সত্যি বিশ্ববাংলা হয়েছে, তাই সারা বিশ্বকে সামাল দিতে গিয়ে সময় বোধহয় লাগছে একটু বেশি । সেই ভেবে তত গা করিনি, কিন্তু ক্রমে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে লাগলো । শেষ পর্যন্ত যখন দেখি মাত্র ১৫ মিনিট বাকি আর বিমান ছাড়ার, তখন বাধ্য হয়ে অভব্যতার শরণাপন্ন হতে হল । শিক্ষা আমাদের পরিশীলিত এবং পরিমার্জিত করে, কিন্তু বাংলা সম্বন্ধে বাস্তব শিক্ষা আমাদের শেখায় যে কিছু ক্ষেত্রে অভদ্রতার কোন বিকল্প হয়না । এবং বাস্তবিকই দেখলাম বহু সঙ্গীসাথী জুটে গেল, সব এক মায়ের সন্তান এক শিক্ষাতেই বড় হয়েছি তো । বোর্ডিং পাস যখন জোগাড় হল তখন বাকি আর ৫ মিনিট । অনেক কাকুতি-মিনতি করে অভিবাসন ইত্যাদি করে শেষ পর্যন্ত যা হোক যখন পৌঁছলাম ভেতরে,  তখন পিছনে ফেলে আসা সেইসব সহযোদ্ধাদের কথা চলে গেছে স্মৃতির অন্তরালে, যারা যথাযত টিকিট থাকা সত্ত্বেও এই বিমানযাত্রা থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল, কেবল এয়ার ইন্ডিয়ার গাফিলতির কারণে । সত্যি আমাদের মস্তিষ্ক কেমন সুবিধাবাদী, ভাবতে অবাক লাগে ।

কিন্তু সেই কথায় বলে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে, তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম দিল্লীতে পৌঁছে । উড়োজাহাজে দিব্যি ছিলাম চেয়ার খানি চেপে, ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি যে কলকাতার বাবাজীরা আমার দিল্লী থেকে শিকাগোর ফ্লাইটে চেক-ইন করায় নি । তাদের আশ্বাসবাণী অনুযায়ী দিল্লীতে নেমে বোর্ডিং-পাস চাইতে গিয়ে দেখি ও হরি, আমার নাম যে নেই !! ইতিমধ্যে তাদের অকর্মণ্যতার দরুন সময় গেছে অতিক্রান্ত হয়ে, এবং লাভের গুড় খেতে গিয়ে সেই ফাঁকে তারা নতুন মানুষজনকে জায়গা দিয়ে বিমান করে ফেলেছে ভর্তি । এমতবস্থায় আমি পড়লাম উভয়সঙ্কটে । এক দিকে ভাবি, বাহ ভালোই তো এই সুযোগে, আরো কদিন ছুটি নাহয় ভোগ করেই নিলাম, তো অপরদিক বলে যেতে যখন হবেই, তো মিছে আর বিলম্ব কেন । বিচ্ছেদের দুঃখ তো তবে দুইবার ভোগ করতে হবে । আশার আলো যে কিছু ছিল না এমন নয়, আশ্চর্যজনক ভাবে সেদিন শিকাগোগামী একটি বিশেষ বিমানের ব্যবস্থার কথা জানালেন এয়ার ইন্ডিয়ার কর্মীরা । কিন্তু সময় যে দোরগোড়ায়, আমার মালপত্র সমস্ত রয়ে গেছে অন্য বিমানে !! তাদের তা জানাতে অবশ্য তারা বললেন যে সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে, এবং কিছু কিছু আশ্বাস যে তারা মিথ্যে দেয় না সেদিনই প্রথম উপলব্ধি করলাম । যাত্রীদের সেই বিশাল লাইন, মালপত্রের খোঁজ, সব কিছু নিজেদের দায়িত্বে সম্পন্ন করে, তারা বসলো আমার ত্রাতার আসনে । পুলিশকর্মীদের অনুরোধ করে নাহয় অতিক্রান্ত হওয়া গেল ট্রানজিটের ঝামেলা । কিন্তু তারপরেও তো অনেক পথ, আর সময় প্রায় নেই বললে অত্যুক্তি হবে না । তখন রাস্তা দেখালেন একজন বিমানকর্মী, আমার মালপত্র সমস্ত কাঁধে তুলে নিয়ে, কেবল তাদের নিজেদের জন্য ব্যবহৃত একটি শর্টকাট এর পথে আমাকে নিয়ে গেলেন তিনি । মালপত্র কাঁধে করে তাঁর দৌড়, এবং তার পিছনে আধো অনুকম্পা আবার আধো প্রত্যাশা বুকে করে তাঁর পশ্চাতধাবন, কেমন যেন এক ইউফোরিয়ার মত ছিল আমার কাছে ।

উত্তেজনার বশে যেন আমার দুঃখবিলাসের সময় কোথায় হারিয়ে গেল বুঝতে পারলাম না । তা ভাল হল না মন্দ সে অবশ্য আমার পক্ষে বলা কঠিন, তবে নিঃসন্দেহে হল এক অনন্য অভিজ্ঞতা । ক্ষণকালের জন্য হলেও নিজেকে যেন ভিআইপি বলে মনে হল, আমার জন্য তাদের এত  উদ্বেগ এবং প্রচেষ্টা দেখে আপ্লুত না হয়েও উপায় ছিল না । অবশ্য নিন্দুকেরা বলবে এসবের তো কোন প্রয়োজন ছিল না, যদি না তারা নিজেরা নিজেদের কাজে গাফিলতি না করতো প্রথমে । তবে সে গাফিলতির মাধ্যমে যদি এমন এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়, যার সমাপ্তি ঘটে মধুরেন সমাপয়েতের মাধ্যমে, তাহলে তো আমরা কেনই বা বলব না 'গাফিলতি আচ্ছে হ্যায়' ।  

(পুনশ্চঃ এই অভিজ্ঞতায় আমার সহযাত্রী ছিল আমার এক বন্ধু । সে না থাকলে হয়তো আমি শেষ পর্যন্ত সেইদিন আর আমার যাওয়া হত না । ) 

No comments:

Post a Comment